আমার দাদুর বয়স বিরাশি বছর। আগের মতো আর চটপটে নন, চলাফেরা সীমিত, কথা কম। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে খাবার খান, তারপর আবার শুয়ে পড়েন। শরীরে অসুস্থতা নেই বললেই চলে, কিন্তু মনটা যেন মরে গেছে অনেক আগেই। ঘরে সবকিছু আছে, সেবার অভাব নেই, তবু দাদুর চোখে যেন অদৃশ্য এক বিষণ্নতা।
আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই, পড়ালেখা করি, খেলা ধুলা করি, কিন্তু দাদুর দিকে ভালোভাবে নজর দেওয়া হয়নি কখনো। একটা সময় আমি লক্ষ্য করলাম, দাদুর চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, কথা বললেও প্রাণ নেই, আর সবার মাঝেও থাকতে চান না। বিষয়টা আমার মনে নাড়া দিল।
![]() |
সেই সময় আমি ‘প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল হালিম স্যারের সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন, “বয়স মানেই অক্ষমতা নয়, একাকিত্বই প্রবীণের সবচেয়ে বড় শত্রু। তুমি চাইলে তোমার দাদু নতুন করে বাঁচতে পারেন।”
এই কথাগুলো যেন আমার ভেতরটা বদলে দিল। আমি খেলা ধুলা বাদ দিয়ে দাদুর পাশে সময় কাটানো শুরু করলাম। প্রতিদিন বিকেলে আমরা একসাথে বসে গল্প করি, পুরনো দিনের স্মৃতি ঘেঁটে দেখি, দাদুর ছোটবেলার কথা শুনি। আমি তাকে বলি আজকের পৃথিবীর গল্প, প্রযুক্তির অগ্রগতি, নতুন নতুন আবিষ্কার। মাঝে মাঝে তাকে বাইরে নিয়ে যাই, হাঁটতে বের হই, আশেপাশের প্রবীণদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেই।
দাদুর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। যে মানুষটা একসময় চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতেন, তিনি এখন মুখে হাসি নিয়ে সকালের আলোয় হাঁটতে বের হন। নিজেকে গুছিয়ে রাখতে শুরু করেছেন। তার চোখে আবারও স্বপ্নের ঝিলিক।
একদিন দাদু আমাকে বললেন, “তুই আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিস। আমি এখন প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাথে কাজ করতে চাই। এই এলাকার অনেক প্রবীণ আমার মতোই একা, আমাদের কিছু করতে হবে।”
আমি অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এতো শক্তি, এত ইচ্ছা কীভাবে ফিরে এলো তার ভেতরে! দাদুর চোখে আমি দেখলাম নতুন জীবনের স্পৃহা।
এরপর আমরা একসাথে কাজ শুরু করলাম। দাদু আমার সহকারি হয়ে উঠলেন—আমার প্রেরণা, আমার অনুপ্রেরণা। তিনি এলাকার অন্য প্রবীণদের সঙ্গে দেখা করলেন, তাদের সমস্যা জানলেন, গল্প করলেন, সাহস দিলেন। তিনি এখন নিজে থেকেই সভা ডাকেন, ফাউন্ডেশনের কাজ নিয়ে চিন্তা করেন, আমার থেকেও বেশি উৎসাহে ভরপুর।
একদিন আমাদের এলাকায় একটি প্রবীণ সমাবেশে দাদুকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। সেখানে তিনি বললেন,
“আমি বিরাশি বছর বয়সে নতুন করে জীবনের মানে বুঝেছি। আমাদের বয়স যতই হোক, যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন কিছু করার ক্ষমতা আছে। প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন আমাকে জীবনের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।”
সবাই দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানালো। কারো চোখে জল, কারো চোখে বিস্ময়। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একটু দূরে, গর্বে বুক ফুলে উঠছিলো।
আমার দাদু, যিনি একসময় একাকিত্বের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলেন, আজ সমাজের আলো হয়ে উঠেছেন। আমি বিশ্বাস করি, শেষ বয়সেও জিতবে দাদু। আর তার এই জয়ের পেছনে অবদান থাকবে ‘প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর, যেটি শুধু একজন প্রবীণকে নয়, সমাজকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।
এটাই আমার গল্প, একজন দাদুর ফিরে আসা, একজন নাতির ভালোবাসা, আর একটি সংগঠনের আলোয় জীবন ফিরে পাওয়া গল্প।
শেষ বয়সেও সত্যিই জিতবে দাদু।