একটা সময় ছিল, বাবা ড. রহিম যখন ক্লাসরুমে দাঁড়াতেন, পুরো হলে পিন পড়লেও শব্দ হতো না। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য শিক্ষক। ছাত্ররা তাঁকে বলত “আলোর মানুষ”—তাঁর ভাষণ, জ্ঞান, আর নীতিতে সবাই মুগ্ধ।



তাঁর জীবনের সবটুকু ভালোবাসা ছিল তার তিন সন্তান—আরিফ, শিলি আর মিতু।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন,

“এখন তোরা-ই আমার জীবন। তোদের মুখের হাসিই আমার দুনিয়া।”

বাড়ির জমি ভাগ করে দিলেন, ব্যাংকের টাকা ভাগ করে দিলেন। বিয়ের সময় সবার জন্য নতুন ফ্ল্যাট কিনে দিলেন। একটিবারও হিসাব কষেননি—কার কত বেশি, কার কত কম। ভেবেছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে সন্তানেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরবে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে,

 “বাবা, তুমি একটু বিশ্রাম নাও, এবার আমাদের পালা।”

কিন্তু সে আশা কবে যেন ছিঁড়ে গেছে...

একদিন হঠাৎ মিতু বলল,

“বাবা, তুমি তো এখন একা, ঘর সামলানো তোমার পক্ষে সম্ভব না। আমরা তোমার জন্য একটা ভাল জায়গা দেখেছি। বৃদ্ধনিবাস... খুব ভালো খাওয়া, চিকিৎসা, সব সুবিধা আছে।”

বাবা কিছু বলেননি। শুধু শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন মিতুর মুখে। সেই চোখে অনেক প্রশ্ন ছিল, অনেক অভিমান ছিল—but একটাও শব্দ ছিল না।

বদ্ধাশ্রমের জীবন

তাকে যখন বৃদ্ধাশ্রমে নামিয়ে দেওয়া হলো, তখন সন্ধ্যা নামছিল।

রিসিপশনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন,আমি কি মাঝে মাঝে বাড়ি যেতে পারব?”

কেউ কোনো জবাব দেয়নি।

ঘরের কোণে একটা ছোট খাট, একটা চেয়ারে বসে তিনি তাকিয়ে থাকেন দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির দিকে। সময় চলে যায়, কেউ আসে না।

কখনো চুপিচুপি কাঁদেন। আবার কখনো নোটবুকে লিখে রাখেন:আজ আরিফের জন্মদিন... বাবাকে একবারও মনে করল না?"

বৃদ্ধাশ্রমে আরেক বৃদ্ধ এসে বললেন, “ডক্টর সাহেব, আপনি অনেক বড় মানুষ ছিলেন না? এখন কেন এমন?”. রহিম চোখের পানি মুছে বললেন,“মানুষ বড় হওয়া কঠিন নয়,সন্তানদের ভালোবাসা ধরে রাখাই আসল বড়ত্ব।আমি জিতিনি।

 শেষ বৃষ্টির দিন

সেদিন বিকেলে বৃষ্টি পড়ছিল।ড. রহিম বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।হঠাৎ তাঁর বুকটা ব্যথা করে উঠল। সহকারীরা দৌড়ে এল।হাত দুটো বুকের ওপর রেখে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “আমি কি ওদের একটু দেখতে পারি... একবার...?”কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল।চিরদিনের জন্য।

এক সপ্তাহ পর আরিফ এসে বৃদ্ধাশ্রমে বাবার ঘর দেখতে এল। টেবিলের ওপর খোলা খাতায় লেখা:

"তুমি যদি কোনোদিন বাবা হও,

চেষ্টা করো যেন তোমার সন্তানেরা তোমার মতো না হয়।

বাবা কখনো বোঝা হয় না,বাবা হয় আশীর্বাদ।মা-বাবাকে যারা বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখে, তারা শুধু দায়িত্ব নয়—একটা আত্মা, একটা ইতিহাস, একটা ভালোবাসা থেকে নিজেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে। বাবা-মা কখনোই বোঝা নয়, তাঁরা আশীর্বাদ—যাদের কাঁধে আমাদের শেকড়।


Previous Post Next Post